কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের পেশা ও আয় নিয়ে এত আলোচনা কেন?
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৯ মে ২০২৪, ২১:৫৯
‘রাফসান দ্যা ছোটো ভাই তার বাবাকে Audi car গিফট করলো, আর ওই দিকে আমার এক বড় ভাই বাসে করে BSMMU-তে যায় Oncology রেসিডেন্সি করতে। আসলে কি ভাই পড়ালেখাটা আমার কাছে এখন overrated লাগে,’– সম্প্রতি তোহার রহমান নামে এক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী তার ফেসবুক ওয়ালে এমন পোস্ট দেন। এটি ব্যাপক ভাইরাল হয় এবং এক ধরনের বিতর্ক তৈরি করে যে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা ও চাকরির চেয়ে কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে সফলতা বেশি কিনা।
তার এই পোস্টটি মূলত ইফতেখার রাফসান, যিনি সামাজিক মাধ্যমে রাফসান দ্য ছোটোভাই হিসেবে পরিচিত তাকে নিয়ে। এই ফুডভ্লগার নিজের আয় দিয়ে বাবা-মাকে একটি দামি গাড়ি উপহার দিচ্ছেন- এরকম একটি ভিডিও প্রকাশ করেন গত রোববার।
ফেসবুকে সেই ভিডিওটি প্রায় দেড় মিলিয়নবার এবং ইউটিউবে সেটি সাত লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। রয়েছে অজস্র মন্তব্য, যেখানে বেশিরভাগ মানুষ রাফসানের এই কাজের প্রশংসা করেন, বলেন তারাও এখান থেকে অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন।
এরপরদিন তোহার রহমানের ওই পোস্ট। তার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে জানা যায় তিনি এমবিবিএস সম্পূর্ণ করেছেন। সেই পোস্টের ঘরেও হাজার মন্তব্য।
যেখানে মাহমুদুল হাসান নামের একজন প্রশ্ন করেছেন, পড়ালেখার উদ্দেশ্য কি শুধু টাকা ইনকাম?
দিদার মাহমুদ লিখেছেন, এই ধরনের তুলনা করা সবচে বড় বোকামি।
এই বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে পুরো সামাজিকমাধ্যম জুড়েই। অন্য সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা যেমন এ নিয়ে পোস্ট দিতে থাকেন, তেমনি এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা মতামত দেন অন্য ব্যবহারকারীরাও।
নিজের ব্যক্তিগত প্রোফাইলেও বিষয়টি ব্যাখ্যা করে পোস্ট দেন ইফতেখার রাফসান। তিনি লেখেন, আমি শুধু আমার পরিবারকে একটা গাড়ি উপহার দিয়ে চমকে দিতে চেয়েছি, কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি যে এটা নিয়ে এত বিতর্ক তৈরি হবে এবং আমার পড়াশোনা বা কাজের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যাবে।
সেই পোস্টে তিনি আরো জানান যে তিনি এখনো শিক্ষার্থী এবং তাকে এই কনটেন্ট তৈরির জন্যও অনেক কষ্ট করতে হয়।
কিন্তু যারা সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার এবং কন্টেন্ট তৈরি করেন, তাদেরকে দেখে আসলে কতোটা প্রভাবিত হয় তরুণরা?
‘এটার ইনফ্লুয়েন্স অবশ্যই আছে,’ বলছিলেন যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইফতেখার রাফসান পড়াশোনা করছেন, সেই ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির, ডিপার্টমেন্ট অব গ্লোবাল স্টাডিজ অ্যান্ড গর্ভনেন্সের সিনিয়র লেকচারার মোহাম্মদ অহিদুজ্জামান।
‘এখন তো প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থীই সামাজিকমাধ্যমে আছে, আর সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের চিন্তা, জীবন-যাত্রা সবকিছুকেই এখন নিয়ন্ত্রণ করছে। ছাত্ররা যেহেতু একটা বড় সময় এখানে কাটায়, তারা স্বাভাবিকভাবেই এখানে নানা কিছুতে প্রভাবিত হয়।’
অহিদুজ্জামান বলেন, রাফসানকে দেখে অনেকে অনুপ্রাণিত হচ্ছে, ভাবছে এত অল্প বয়সে সাকসেসফুল হওয়া যায়, কিন্তু এর নেতিবাচক দিক হলো এখানে সাকসেসফুল বলতে শুধুমাত্র আর্থিক দিকটা দেখছে সবাই। তবে এর ইতিবাচক দিক হলো প্রথাগত পড়াশোনা ও চাকরির পাশাপাশি এটাও এখন ক্যারিয়ারের একটা পার্ট হতে পারে।
অনেক শিক্ষার্থীও তেমনটাই মনে করেন।
বার্মিংহাম সিটি ইউনিভার্সিটিতে আইন নিয়ে পড়ছেন রামিসা মিফতা। ছুটিতে ঢাকায় থাকা এই শিক্ষার্থীর সাথে কথা হয় বিবিসি বাংলার।
‘দেখুন তারা হার্ডওয়ার্ক করছে, আর কনটেন্ট মানসম্মত বলেই সেখান থেকে অর্থ আসছে, এটা ভালো ক্যারিয়ার হতে পারে,’ বলেন মিফতা।
তবে নিজে আইনজীবী হওয়ার লক্ষ্যের কথা জানান মিজ মিফতা।
সদ্য এইচএসসি পাশ করা তামজীদ হোসেনের লক্ষ্য এন্টারপ্রেনার হওয়া। তিনি বলেন, সবাই সবার ফিল্ডে কাজ করবে, কিন্তু সবাই যদি এক ফিল্ডে চলে আসে সেটা ভালো কিছু হবে না।
তবে এই বিতর্কে একটা ভিন্ন বাস্তবতাও সামনে আসছে।
‘আমাদের প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থা জব ফোকাসড না,’ বলেন অহিদুজ্জামান।
‘কনটেন্ট ক্রিয়েশন এখনো দেশের বাইরে মেইনস্ট্রিম হয়ে ওঠেনি, কিন্তু বাংলাদেশে মেইনস্ট্রিম হয়ে উঠেছে। আর এর কারণ হলো এখানকার শিক্ষাব্যবস্থা ক্যারিয়ার নির্ভর নয়, ছাত্ররা চিন্তা করে যে পড়াশোনা শেষে চাকরির নিশ্চয়তা নাই।’
‘অন্যদিকে এই অঞ্চল ছোট হলেও এখানে ভিউ অনেক বেশি, ফলে প্রফিটও বেশি, যা আর্থিক দিক থেকে সাহায্য করে,’ বলছিলেন এই শিক্ষক।
এটি নিয়ে হতাশা আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ইমরান হোসেনেরও।
‘সমস্যা হলো আমরা যারা বাবা-মার স্বপ্ন পূরণে ছোটবেলা থেকে পড়াশোনা করে যাচ্ছি, এখন যখন দেখি চাকরির বাজারে অনিশ্চয়তা, আর একটা প্রথম শ্রেণির চাকরিতে যে বেতন দেয় সেটা দিয়ে সংসার চালিয়ে বাবা-মার দেখভাল করার জন্য ওই অর্থ অপর্যাপ্ত হয়ে যায়।’
‘আবার সবাই প্রথম শ্রেণির চাকরিও পায় না, জীবিকার তাগিদে যে কোনো একটা চাকরি তাকে করতে হয়, ফলে স্বপ্ন থাকলেও সেটা পূরণ হয় না তখন।’
তিনি জোর দেন আর্থিক সমতার ওপর। ‘দিনশেষে একটা প্রশ্ন পড়াশোনা শেষ করে যতোটা মূল্য পাওয়া দরকার সেটা কি পাচ্ছি? যখন কোনো ছোট চাকরিতে ঢুকবো সমাজ প্রশ্ন করবে ঢাবিতে পড়ে কী করলা, কয় টাকা বেতন পাও?’
ইমরান বলেন, যে কেউ যে কোনো পেশায় যেতে পারে, কিন্তু আর্থিক সমতা অনেক দরকার। সরকার বা নীতিনির্ধারকেরা যদি পেশাগুলোর ভেতরে আর্থিক গ্যাপ কমানোর চিন্তা করতো তাহলে এই প্রশ্নগুলো আসতো না।
একটি উন্নয়ন সংস্থায় তরুণদের নিয়ে কাজ করা ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক শরীফুল হাসান এটাকে অবশ্য খুব স্বাভাবিকভাবে দেখতে চান। ‘লাখ লাখ কনটেন্ট ক্রিয়েটর, সবাই তো অডি গাড়ি কিনতে পারছে না।’
তিনি বলেন, যত লোক বিসিএস ক্যাডার বা সরকারি চাকরিতে ঢুকছে তার চেয়ে অনেক বেশি লোক অন্য কোনো চাকরি বা ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছে। আর কনটেন্ট ক্রিয়েশন পেশাটা একটা আলাদা বৈচিত্র্য এনেছে, বাড়তি আয় এনেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী হিরা সরকারের কাছে এই কনটেন্ট ক্রিয়েশন পেশাটা একটা ফ্যান্টাসির মতো। ‘এখন আরো অনেকের মতো আমি নিজেও মনে করি কনটেন্ট ক্রিয়েটর হবো, কারণ চোখের সামনে ফলাফল। তবে এটা একটা ফ্যান্টাসির মতো, যেটা সবসময় স্পর্শ করা কঠিন। কিন্তু আমরা প্রতিনিয়ত প্রভাবিত হচ্ছি।’
অভিভাবকরা কীভাবে দেখেন এই নতুন পেশাকে?
ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান, তার ভাগ্নীকে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে এনেছেন। তিনি বিবিসিকে বলেন, এটা আমি অবশ্যই ইতিবাচকভাবে দেখি। এই পেশায় স্বাধীনতা আছে। মনমতো যেকোনো সময়, যেকোনোভাবে, যেকোনো জায়গা থেকে কাজটা করা যায়, এটা এখন ক্যারিয়ার হিসেবে নেয়া যেতেই পারে।
আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সেমিস্টারে ভর্তি হওয়া তার ভাগ্নী মাশরুফা মাহবুব বলেন, ‘আমি মনে করি পড়াশোনা করে ক্যারিয়ার গড়াটাই আসল। সেটা স্থায়ী, সোশ্যাল মিডিয়া ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু আপনি যদি পড়াশোনা করে নিজের ভিত তৈরি করেন, তাহলে সেটা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।’